গুরুদেবের গুরুনানক - রবীন্দ্রনাথের মানসপটে গুরুনানকের প্রভাব

গুরুদেবের গুরুনানক - রবীন্দ্রনাথের মানসপটে গুরুনানকের প্রভাব

গুরুদেবের গুরুনানক
 

এই বছরে অর্থাৎ ২০২১-এ গুরু নানকের ৫৫২ তম জন্ম দিবস। আর সেই ৫৫২ তম জন্মদিবস উপলক্ষে গুরু নানককে শ্রদ্ধা জানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিখ সমাজের মানুষজন। গুরু নানক ১৪৬৯ সালের ২০শে অক্টোবর এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান পাকিস্তানের লাহোরের নিকটে অবস্থিত তালবন্দী গ্রামে। বর্তমানে এই গ্রামের নাম গুরুর নামানুসারে নানকানা সাহেব রাখা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “আজ প্রায় চারশো বৎসর হইল পঞ্জাবে তলবন্দী গ্রামে কালু বলিয়া একজন ক্ষত্রিয় ব্যাবসা-বাণিজ্য করিয়া খাইত। তাহার এক ছেলে নানক। নানক কিছু নিতান্ত ছেলেমানুষ নহে। তাহার বয়স হইয়াছে, এখন কোথায় সে বাপের ব্যাবসা-বাণিজ্যে সাহায্য করিবে তাহা নহে–সে আপনার ভাবনা লইয়া দিন কাটায়, সে ধর্মের কথা লইয়াই থাকে”।…

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

… নানক যে মহত্ত্ব লইয়া জন্মিয়াছিলেন সে তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই নিবিয়া গেল না। তিনি যে ধর্মের সংগীত, যে আনন্দ ও আশার গান গাহিলেন, তাহা ধ্বনিত হইতে লাগিল। কত নূতন নূতন গুরু জাগিয়া উঠিয়া শিখদিগকে মহত্ত্বের পথে অগ্রসর করিতে লাগিলেন।….

…. আজ যে শিখ জাতি দেখিতেছ, যাহাদের সুন্দর আকৃতি, মহৎ মুখশ্রী, বিপুল বল, অসীম সাহস দেখিয়া আশ্চর্য বোধ হয়, এই শিখ জাতি নানকের শিষ্য। নানকের পূর্বে এই শিখ জাতি ছিল না। নানকের মহৎ ভাব ও ধর্মবল পাইয়া এমন একটি মহৎ জাতি উৎপন্ন হইয়াছে। নানকের ধর্মশিক্ষার প্রভাবেই ইহাদের হৃদয়ে তেজ বাড়িয়াছে, ইহাদের শির উন্নত হইয়াছে, ইহাদের চরিত্রে ও ইহাদের মুখে মহৎ ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে। কালু যে টাকা রোজগার করিয়াছিল নিজের উদরেই তাহা খরচ করিয়াছে, আর নানক যে ধর্মধন উপার্জন করিয়াছিলেন আজ চারশো বৎসর ধরিয়া মানবেরা তাহা ভোগ করিতেছে”।….

শিখ ধর্মের প্রভাব রবীন্দ্র-মানসে প্রায় অপরিজ্ঞাত, তাই পরিচিত রবীন্দ্রনাথের অপরিচিত এই শিখ যোগসূত্র রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। মানসী গীতিকাব্য ৩১-৩৪ বছরের মধ্যে লেখা হলেও শিখ গুরুদ্বার ও গুরু নানকের সঙ্গে গুরুদেবের প্রথম সংযোগ ঘটে ১৮৭৩-এ, যখন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি অমৃতসর পৌঁছন, বয়স তাঁর এগারো।

রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গানটি হল ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে' এই গানটি  গুরু নানক  রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ। কীভাবে কবি শুনেছিলেন এই গান?‌ ১৮৭৩ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে উপনয়নের পর বাবা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হয়েছিলেন তিনি। প্রথমে শান্তিনিকেতন যান। সেখান থেকে বাবা–ছেলে যান অমৃতসরে। প্রায় এক মাস ছিলেন সেখানে। অমৃতসরে থাকার সময় প্রায় প্রতিদিন স্বর্ণমন্দির যেতেন তাঁরা। সেখানেই গানটি শোনেন বালক রবি।

“গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে

তারকামণ্ডলা জনক মোতী

ধূপ মলয়ানিলো পবন চমরো করে

সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি।…

অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম গান।

গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।।

ধূপ মলয়ানিল,  পবন চামর  করে,

সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি রে।।…

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল এই গান রচনা ও প্রকাশের ইতিহাস সম্পর্কে লিখেছেন:

...ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের পাক্ষিক মুখপত্র ধর্মতত্ত্ব পত্রিকার ১ ভাদ্র ১৭৯৪ শক [১২৭৯; 1872] সংখ্যার [৪ । ১৪] ৭৩৮ পৃষ্ঠায় নানকের ভজনটি প্রথম বঙ্গাক্ষরে প্রকাশিত হয়। এর পরই তত্ত্ববোধিনী-র ফাল্গুন সংখ্যার ১৯১-৯২ পৃষ্ঠায় ‘সংবাদ’ শিরোনানায় ২৪ ভাদ্র লাহোর সৎসভার দ্বিতীয় সাংবাৎসরিক প্রসঙ্গে গদ্যানুবাদ-সহ গানটি মুদ্রিত হয়। পদ্যানুবাদটি সুর-সংযোজিত [‘রাগিণী জয় জয়ন্তী – তাল ঝাঁপতাল] হয়ে ১১ মাঘ ১২৮১ [শনি 23 Jan 1875] তারিখে আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চচত্বারিংশ সাংবাৎসরিক সায়ংকালীন উপাসনায় গীত হয় ও পরবর্তী ফাল্গুন সংখ্যায় তত্ত্ববোধিনী-র ২০৯ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়। ...আমাদের অনুমান পদ্যানুবাদটি রবীন্দ্রনাথেরই কৃত। ফাল্গুন সংখ্যায় অনুবাদ-সহ মূল অংশটি প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে বোলপুর  হয়ে অমৃতসরে আসেন। খুবই সম্ভব যে, তিনি তত্ত্ববোধিনী মারফত রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। অমৃতসরে পিতার সঙ্গে যখন গুরু-দরবারে উপস্থিত থাকতেন, তখন অন্যান্য শিখ ভজনের সঙ্গে এই গানটিও তিনি শুনেছিলেন, এমন সম্ভাবনার কথা সহজেই ভাবা যেতে পারে। আর এই যোগাযোগের অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথ ভজনটির বঙ্গানুবাদ করেন। ...আমাদের এই আনুমানিক সিদ্ধান্ত যদি বিদগ্ধজনের সমর্থনযোগ্য হয়, তবে এটি-ই রবীন্দ্রনাথ-রচিত প্রথম ব্রহ্মসংগীত বলে গণ্য হবে। ...তবে আমাদের মত গ্রাহ্য হলে সেখানে বয়স ও সালটি সংশোধনের প্রয়োজন হবে, লিখতে হবে – ‘বয়স ১১। ১২৭৯। ১৮৭৩’।

শিখ ভজন ‘এ হরি সুন্দর, এ হরি সুন্দর । তেরো চরণপর সির নাবেঁ...” এবং ‘বাদৈ বাদৈ রম্যবীণা বাদৈ থেকেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন এ হরি সুন্দর, এ হরি সুন্দর। মস্তক নমি তব চরণ পরে। এবং বাজে বাজে রম্যবীনা বাজে।

প্রবাসী পত্রিকার চৈত্র ১৩১৬ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘শিবাজী ও গুরু গোবিন্দ সিংহ” প্রবন্ধ । এ ছাড়া ‘বীর গুরু’ ও ‘শিখ স্বাধীনতা’ নিয়ে দুটি প্রবন্ধ রচনা করেন বালক পত্রিকাতেও । মানসী কাব্যের ‘গুরু গোবিন্দ’ ও ‘নিষ্ফল উপহার” কবিতা, ‘কথা’ কাব্যের ‘শেষ শিক্ষা” ‘প্রার্থনাতীত দান’ ‘বন্দীবীর প্রভৃতি কবিতাও রবীন্দ্রনাথ শিখ-চর্চার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।

 

শিখকাহিনী নিয়ে লেখা তিনটে কবিতাগল্প হল ‘বন্দীবীর’, ‘প্রার্থনাতীত দান’ ও ‘শেষ শিক্ষা’। রচনাগুলির উৎস জে.পি.কানিংহাম রচিত ‘The History of Sikhs’। কানিংহামের গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ‘বালক’ পত্রিকার জন্য কবি ইতিপূর্বেই (১২৯২) ‘শিখস্বাধীনতা’ নামে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘বন্দীবীর’ কাহিনী সেখানে আনুপূর্বিক বর্ণিত হয়েছে। গদ্য করে সেখানে যে কথা তিনি বলেছেন, এখানে কবিতার আকারে তা-ই পুনর্বিবৃত হয়েছে। শিখজাতির স্বাধীনতাপ্রিয়তা এবং সেজন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন করার কথাও এমনকি ‘আগে কে-বা প্রাণ করিবেক দান / তারি লাগি তাড়াতাড়ি’র কথা প্রবন্ধে ও কবিতায় উল্লেখ করেছেন।

বন্দীবীর (৩০ আশ্বিন, ১৩০৬):

‘বন্দী বীর’ কবিতায় দেশকে মোগল শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য শুধু প্রাণ বিসর্জনই নয়, প্রিয় পুত্রকে নিজের হাতে হত্যা করার মতো কঠোর কাজ কাজির আদেশে করতেও বন্দা পিছপা হননি, কারণ গুরুগোবিন্দ (শিখদের শেষ গুরু) মৃত্যুর সময় বন্দার (যিনি ছিলেন এক বৈরাগী) উপর শিখ জাতির স্বাধীনতা রক্ষার ভার দিয়ে যান। স্বজাতির পরিত্রাণ করাই তাঁর ব্রত ছিল। এই ব্রত পালনে কত দুঃখ, কত আঘাতই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে; মৃত্যু তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। বন্দার দেশপ্রেম, গুরুভক্তি এবং নির্ভিক স্বভাবের কথাই কবি এই গল্পকথায় প্রকাশ করেছেন, তাই তো কবিতাটি শেষ হয়েছে এইভাবে, -

“….বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক

        সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ।

স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি'

       একটি কাতর শব্দ”।….

“মোঘল ও শিখের বিরোধে শিখদের বীর্য ও আত্মদান এবং মোঘলদের নির্মম পীড়নের এই কাহিনী পাঠকের কাছে সহজেই হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদীর শক্তির শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীন সংগ্রামের রূপক”।

‘প্রার্থনাতীত দান’ (২ কার্ত্তিক ১৩০৬)

‘প্রার্থনাতীত দান’ কবিতার গল্পকথাও ‘শিখ স্বাধীনতা’ প্রবন্ধে আছে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় বালক পত্রিকার ১২৯২ সালের কার্ত্তিক সংখ্যায়। কবিতাটি ক্ষুদ্রকার, ‘শিখ স্বাধীনতা’ রচনায় তা আরও ক্ষুদ্র আকারেই বর্ণিত। কিন্তু তার সারকথা যা কবিতার শিরোনামের পরেই কবি স্বয়ং লিখে দিয়েছেন তাতেই ব্যক্ত হয়েছে। “শিখের পক্ষে বেণীচ্ছেদন ধর্মপরিত্যাগের ন্যায় দূষণীয়” – তাই নবাব যখন তরুসিং-এর কাছে তার দীর্ঘ বেণীটি ছেদন করে তাঁকে দিতে অনুরোধ করলেন এবং বিনিময়ে তাঁকে ক্ষমা করবেন বলে জানালেন, তখন তরুসিং প্রত্যুত্তরে বললেন –

“….তরুসিং কহে, "করুণা তোমার

          হৃদয়ে রহিল গাঁথা--

যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব,

          বেণীর সঙ্গে মাথা”।

“ধর্মরক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া শিখজাতির কাছে অতি সহজ কাজ। কিন্তু প্রাণভয়ে ধর্মত্যাগ তাদের কাছে অসম্ভব। এখানে একটি ছোট্ট পদ্য পুরোপুরি গল্প হয়ে গেছে, একে নতুন ধরণের শৈলী নিয়ে পরীক্ষা তো বলাই যায়। এটি একটি সার্থক অনুগল্প, সংলাপেই দুই চরিত্র পুরো ফুটে উঠেছে স্বাতন্ত্রে এবং ব্যক্তিত্বে”। “লেখাটিতে কিছু হাসি কিছু ব্যঙ্গ – একটু লঘু চটুলতা কিন্তু ভিতরে আপোষহীন যুদ্ধ”।

১৩০৬ সালে কথা কাব্যগ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৩১০ সালে মোহিত চন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশকালে মানসীর গুরুগোবিন্দ

কবিতাটি ‘কথা’র অন্তর্ভূক্ত করেন।পরবর্তীকালে ‘কথা ও কাহিনী’ যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় (ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, ১৩১৫ সালে) তখনও এই কবিতাটি ‘কথা’র অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং রবীন্দ্ররচনাবলীতে সপ্তম খন্ডে সেই ভাবেই এই কবিতাটি মুদ্রিত আছে। কবিতাটির রচনাকাল ১২ই জ্যৈষ্ট ১২৯৫। ‘বীরগুরু’ প্রবন্ধটি লেখা আরও আগে ১২৯২ সালের শ্রাবণ মাসে। ঐ প্রবন্ধে গুরুগোবিন্দের ঐতিহাসিক চরিত্রের যে পরিচয় আছে, তাকেই এই কবিতায় কবি চিত্রিত করেছেন। আত্মশক্তি লাভের জন্য বারো বছর যমুনা নদীর তীরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে আত্মগোপন করে গুরুগোবিন্দের যে জীবনসাধনার কথা ক্যানিংহামের গ্রন্থে (এখানে কুড়ি বছরের কথা আছে) আছে, তাকেই কবি কবিতায় রূপ দিয়েছেন –

"বন্ধু, তোমরা ফিরে যাও ঘরে
          এখনো সময় নয়'--
নিশি অবসান, যমুনার তীর,
ছোটো গিরিমালা, বন সুগভীর,
গুরু গোবিন্দ কহিলা ডাকিয়া

          অনুচর গুটি ছয়”।….

কবিতাটি ‘মানসী’র অন্তর্গত, এই সময় কবির লেখনিতে কবিতাগল্পের স্রোত বেগবতী ছিল না, সে জন্য কথা কাব্যের অন্যান্য কবিতায় কাহিনীর যে ঠাস-বুনোট লক্ষ করা যায়, এখানে সেটি অনুপস্থিত। কবিতাটিতে কাহিনীর বীজটি রয়েছে। গুরুগোবিন্দের চরিত্রটি উজ্জ্বলভাবে কবিতার কাহিনীতে ফুটে উঠেছে। গল্প বলার ছলে গুরুগোবিন্দের জীবন ইতিহাস বর্ণনা কবিতায় কাহিনীর স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ যুক্ত করেছে। তবে সেভাবে কাহিনী বর্ণিত না হওয়ায় কবিতাটি গল্প কবিতার দলে আপন আসন করে নিতে পারেনি।

‘শেষ শিক্ষা’ (৬ কার্ত্তিক, ১৩০৬)

কথার কবিতা ‘শেষ শিক্ষা’-য় আবার তিনি ‘বীর গুরু’ প্রবন্ধের গুরু গোবিন্দকে স্মরণ করেছেন। বোঝা যায়, আদর্শ দেশনায়ক হিসাবে গুরু হিসাবে গুরুগোবিন্দ রবীন্দ্রনাথের ‘মনে সজীব প্রেরণার আকারে বর্তমান ছিলেন। এই আদর্শগুরু, আদর্শ দেশপ্রেমিকের কথা প্রবন্ধে ও কবিতায় একাধিকবার বলে তিনি বালক তথা সাধারণ মানুষের মনে মুদ্রিত করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রজীবনীকার আরও অনুমান করেছেন, “ এইসব রচনা প্রধানত বালকদের উদ্দেশ্য করে লেখা হলেও রবীন্দ্রনাথের সমকালীন জাতীয়তাবোধের অন্যতম দিকনির্দেশক রূপে গণ্য হতে পারে। ভারতবর্ষে বিশেষতঃ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে যে জাতীয়তাবোধের উণ্মেষ ঘটেছিল তাকে একজন জাতীয় বীরের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা স্বাভাবিক”। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মধ্যে এই জাতীয় বীরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তাই তাঁকে ‘দেশনায়ক’ বলে সম্বোধন করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ‘বীরগুরু’ (১২৯২) প্রবন্ধে সংক্ষেপে ‘শেষ শিক্ষা’ কবিতাটির কাহিনীও লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

“…. গোবিন্দের মৃত্যুঘটনা বড়ো শোচনীয়। কেহ কেহ বলে, ক্রমাগত শোকে বিপদে নিরাশায় অভিভূত হইয়া গোবিন্দ শেষ দশায় কতকটা পাগলের মতো হইয়াছিলেন ও জীবনের প্রতি তাঁহার অতিশয় বিরাগ জন্মিয়াছিল। একদিন একজন পাঠান তাঁহার নিকট একটি ঘোড়া বিক্রয় করিতে আসিয়াছিল; গোবিন্দ সেই ঘোড়া কিনিয়া তাহার দাম দিতে কিছুদিন বিলম্ব করিয়াছিলেন। অবশেষে পাঠান ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে গালি দিয়া তরবারি লইয়া আক্রমণ করিল। গোবিন্দ পাঠানের হাত হইতে তরবারি কাড়িয়া লইয়া তাহাকে কাটিয়া ফেলিলেন।

এই অন্যায় কার্য করিয়া তাঁহার অত্যন্ত অনুতাপ উপস্থিত হইল। তিনি সেই পাঠানের পুত্রকে অনেক অর্থ দান করিলেন। তাহাকে তিনি যথেষ্ট স্নেহ করিতেন এবং তাহার সহিত খেলা করিতেন। একদিন সেই পাঠান-তনয়কে তিনি বলিলেন, "আমি তোমার পিতাকে বধ করিয়াছি, তুমি যদি তাহার প্রতিশোধ না লও তবে তুমি কাপুরুষ ভীরু”।…

এই কবিতায় গুরুগোবিন্দ মৃত্যু চেয়েছেন, কিন্তু তিনি আত্মহত্যা করেননি। যে পাঠানকে তিনি হত্যা করেছেন তাঁরই পুত্রের হাতে তিনি মরতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি অপেক্ষা করেছেন, বেশ কয়েক বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষা। অপেক্ষার অবসানে তিনিই নিজেই দুটো নাটকের মুহুর্ত সৃষ্টি করেছেন ওই পাঠানপুত্রের সামনে। প্রথম পরিস্থিতিতে মামুদ নিজেকে বহুকষ্টে সামলে নিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় পরিস্থিতিতে সে আর আত্মসংবরণ করতে পারেনি, তার অতি প্রিয় গুরুকে হত্যা করেছে। গুরুগোবিন্দ শুধু কি প্রায়শ্চিত্তই করেছেন, না কি নিজের মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করেছেন? এক অদ্ভুত মনস্তাত্বিক জটিলতা নিয়ে চরিত্রটি আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে, সর্বজনমান্য গুরুকে যা এক রক্তমাংসের মানুষে পরিণত করেছে। কবিতায় মামুদের চরিত্রটিও উল্লেখের দাবী রাখে। গুরুগোবিন্দকে সে পিতার মতই ভালবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে, অথচ সেই গুরুই যে তার পিতার হত্যাকারী একথা যখনই তার মনে হয়েছে ভিতরে ভিতরে তার রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার জন্মদাতা পিতার মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার পিতৃহত্যা হয়েছে তার নিজের হাতে। এতে “রক্তের ঋণ শোধ হল, ভালবাসার ঋণ জমে উঠল পর্বতের মতো। এভাবেই মামুদের একটি সংহত ট্রাজিক মূ্র্ত্তি তৈরি হয়েছে”। গুরু ও শিষ্যের চরিত্রদুটি আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। রচনার ক্ষুদ্র সংহত আয়তন, চরিত্রসৃষ্টি, কাহিনীবিন্যাস, পরিণতির চমৎকারিত্ব কবিতাটিকে সার্থক কবিতাগল্পে পরিণত করেছে –

“….কহিলেন, "এতদিনে হল তোর বোধ

কী করিয়া অন্যায়ের লয় প্রতিশোধ।

শেষ শিক্ষা দিয়ে গেনু--আজি শেষবার

আশীর্বাদ করি তোরে হে পুত্র আমার”।

আজ এমনি চরিত্রের আকাল সারা পৃথিবীতে। কোথায় আত্মঅনুশোচনা, আত্মধিক্কার? অন্যায়, অনৈতিকতাকে জীবনের অংশ করে তোলা হচ্ছে। চতুর বোঝাপড়া আর অন্যায়কে অন্যায় মনে না করার এই দুর্দিনে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ শিক্ষা’ বা ‘শেষ শিক্ষার’ রবীন্দ্রনাথকে বড় প্রয়োজন।

নিস্ফল উপহার (২৭শে জ্যৈষ্ট, ১২৯৫)

‘কথা’ কাব্যের ‘গুরুগোবিন্দ’ কবিতাটি রচনার পরের দিনই গুরুগোবিন্দের চরিত্রের মহত্ত্বের পরিচায়ক আর একটি ঘটনা নিয়ে কবি রচনা করেছেন ‘নিস্ফল উপহার’ কবিতাটি। এই কবিতায় বর্ণিত আখ্যায়িকাটি কবি ইতিহাস গ্রন্থের ‘বীরগুরু’ (শ্রাবণ ১৮৮৫) প্রবন্ধে বর্ণনা করেছেন, উভয় বর্ণনাতেই শিখগুরুর ধনের প্রতি উদাসীনতাই ফুটে উঠেছে,

“….ধনের প্রতি গোবিন্দের বিরাগ সম্বন্ধে একটা গল্প আছে বলি। গোবিন্দের একজন ধনী শিষ্য তাঁহাকে পঞ্চাশ হাজার টাকার মূল্যের একজোড়া বলয় উপহার দিয়াছিল। গোবিন্দ তাহার মধ্য হইতে একটি বলয় লইয়া নদীর জলে ফেলিয়া দিলেন। দৈবাৎ পড়িয়া গেছে মনে করিয়া একজন শিখ পাঁচ শত টাকা পুরস্কারের লোভ দেখাইয়া একজন ডুবারিকে সেই বলয় খুঁজিয়া আনিতে অনুরোধ করিল। সে বলিল, "আমি খুঁজিয়া আনিতে পারি, যদি আমাকে ঠিক জায়গাটা দেখাইয়া দেওয়া হয়।' শিখ গোবিন্দকে ডাকিয়া আনিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বালা কোন্‌খানে পড়িয়া গেছে। গোবিন্দ অবশিষ্ট বালাটি লইয়া জলে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া বলিলেন, "ওইখানে।' শিখ তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া আর খুঁজিল না”। ….

ভারতীয় ধর্মের মূল মন্ত্র যে নিস্কাম ত্যাগ, গুরুগোবিন্দ শিষ্য রঘুনাথকে তাঁরই শিক্ষা দিয়েছেন, শিষ্যের দেওয়া মহামূল্য বলয় দুটি নদীবক্ষে বিসর্জন দিয়ে -

"…. এখনো উঠাতে পারি' করজোড়ে যাচে,

"যদি দেখাইয়া দাও কোন্‌খানে আছে।'

দ্বিতীয় কঙ্কণখানি ছুঁড়ি দিয়া জলে

গুরু কহিলেন, "আছে ওই নদীতলে”।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “…. শিখদিগের শেষ গুরু গুরুগোবিন্দ যেমন বহুকাল জনহীন দুর্গম স্থানে বাস করিয়া, নানা জাতির নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া, সুদীর্ঘ অবসর লইয়া আত্মোন্নতিসাধনপূর্বক তাহার পর নির্জন হইতে বাহির হইয়া আসিয়া, আপনার গুরুপদ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তেমনি আমাদের যিনি গুরু হইবেন তাঁহাকেও খ্যাতিহীন নিভৃত আশ্রমে অজ্ঞাতবাস যাপন করিতে হইবে; পরম ধৈর্যের সহিত গভীর চিন্তায় নানা দেশের জ্ঞানবিজ্ঞানে আপনাকে গড়িয়া তুলিতে হইবে; সমস্ত দেশ অনিবার্যবেগে অন্ধভাবে যে আকর্ষণে ধাবিত হইয়া চলিয়াছে সেই আকর্ষণ হইতে বহুযত্নে আপনাকে দূরে রক্ষা করিয়া পরিষ্কার সুস্পষ্ট রূপে হিতাহিতজ্ঞানকে অর্জন ও মার্জন করিতে হইবে। তাহার পরে তিনি বাহির হইয়া আসিয়া যখন আমাদের চিরপরিচিত ভাষায় আমাদিগকে আহ্বান করিবেন, আদেশ করিবেন, তখন আর-কিছু না হউক, সহসা চৈতন্য হইবে–এতদিন আমাদের একটা ভ্রম হইয়াছিল, আমরা একটা স্বপ্নের বশবর্তী হইয়া চোখ বুজিয়া সংকটের পথে চলিতেছিলাম, সেইটাই পতনের উপত্যকা”।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait